ফ্যান ফিকশন কপিরাইট : মুখোমুখি লেখক ইভান গুপ্ত
১) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : প্রথমেই যেটা জিজ্ঞাসা করব সেটা হল ফ্যান ফিকশন লেখা কি অপরাধ ?
ইভান : একেবারেই নয় । যে কেউ চাইলেই ফ্যান ফিকশন লিখতে পারেন ।
২) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : কিন্তু তাহলে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অডিও স্টোরি যারা বানায় তারা টেক ডাউন নোটিশ পাচ্ছেন, তাদের ভিডিওকে স্ট্রাইক করা হচ্ছে , ইত্যাদি । এটা কেন ?
ইভান : ফ্যান ফিকশন লেখা , অরিজিনাল ফিকশনকেই কমপ্লিমেন্ট করে । সুতরাং যে কেউ , তার যদি কোন গল্পের চরিত্র কে পছন্দ হয় , সে যদি সেই গল্পের লেখকের ভক্ত হয় , তাহলে সে চাইলেই ফ্যান ফিকশন লিখতে পারে এবং তার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনকে সেই গল্প পড়ে শোনাতে পারে বা সেই গল্প থেকে নাটক বা যে কোন কিছু অডিও স্টোরি বানিয়ে সে তাদের শোনাতে পারে , দেখাতে পারে । এই অব্দি কোন অপরাধ নয় । সমস্যাটা তখনই শুরু হয় যখন কেউ সেই ফ্যান ফিকশন থেকে কোন অডিও স্টোরি বানিয়ে, ব্যবসায়িকভাবে সেটা কাউকে শোনাতে গেল বা দেখাতে গেল বিনা অনুমতি নিয়ে । অর্থাৎ সে যদি কোন বাণিজ্যিক লাভ করে , সেই ক্ষেত্রেই হয়ে যায় অপরাধ । কারণ হচ্ছে , মূল যে চরিত্রগুলো যেমন কাকাবাবু বা ব্যোমকেশ বা ফেলুদা ..... , সেই চরিত্রের নামটাকে অর্থাৎ ফেলুদা নামটা বা 'প্রদোষ চন্দ্র মিত্র' এই পুরো নামটা , বা চরিত্রের স্কেচ, একটা ব্র্যান্ড যেটা অন্য একজনের আইডিয়া । সেই ব্র্যান্ডটাকে তো ব্যবহার করছে , ব্যবহার করতে গেলে সেই ব্র্যান্ডের যে কপিরাইট হোল্ডার , তার অনুমতি নিতে হবে , যদি সে ব্যবসায়িকভাবে সেটাকে করতে চায় । নইলে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আইন লঙ্ঘন হয় ।
৩) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : তার মানে আপনি বলছেন যে যারা এই ধরনের নানান রকম নোটিশ পাচ্ছেন বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এই ধরনের চিঠি পাচ্ছেন , তারা ফ্যান ফিকশন এর যে নিয়মটা, সেটা মান্য করছেন না ?
ইভান : একেবারেই করছে না । ব্যাপারটা হলো যে , ইউটিউবে একটা চরিত্রের ফ্যান ফিকশন আপনি আনুন , সেটা ইউটিউবে আপনি দেখান , আপনি আপনার মনিটাইজেশন অর্থাৎ যেটা থেকে ইউটিউবে চ্যানেলটাকে চালিয়ে যে ইনকামটা হয়, প্রচুর মানুষের ভিউ হলে, ইউটিউব যে টাকাটা দেয় বছরে আপনাকে, সেই অপশনটা আপনি অফ করে দিলেন বা ভিডিওটাকে আপনি প্রাইভেট করে দিলেন , মনিটাইজেশন অনেক সময় অটো অন হয়ে যায় , আপনি ভিডিওটাকে প্রাইভেট করে দিন অর্থাৎ আপনি যাদের যাদের লিংক পাঠাবেন তারাই একমাত্র সেটা দেখতে পারবে । কিন্তু আপনি সেটা না করে পপুলার কোন লিটারারি ক্যারেক্টারের ছবি , তার নাম ইত্যাদি দিয়ে , আপনি একটা গল্পকে মানুষের কাছে তুলে ধরছেন , সেটা তো অবশ্যই একটা ভুল কাজ । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটা হয়, আইনি ঝামেলা কে মানুষ ভয় পায় কিন্তু তবুও আইনটা ভালো ভাবে না জেনেই কাজ শুরু করে ফেলে ।
৪) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : কিন্তু এর পাশাপাশি আমরা এটাও দেখছি যে ফ্যান ফিকশন কিন্তু ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছে । মানুষের ফ্যান ফিকশন এর প্রতি এই আগ্রহটা এত বেশি করে কেন ?
ইভান : সেটা খুবই অর্থবহ । কারণ বিদেশে ফ্যান ফিকশন তো বরাবরই অনেকদিন ধরেই চলছে । ওখানে ফ্যানফিকশনের একটা আলাদা genre রয়েছে , কিন্তু আমাদের দেশে ফ্যান ফিকশন সেই ভাবে নেই , সেরকম ভাবে ছিল না একটা সময় পর্যন্ত । নামকরা পত্র পত্রিকায় অর্থাৎ যেগুলো মানুষ চট করে কিনতে পারেন, সেখানে নতুন মৌলিক বাংলা গল্প তেমন মানের হচ্ছে না । নাম করা লেখকদের একটি বড় অংশ আর জীবিত নেই । একটা শূন্যতা তৈরী হয়েছে যেটা এই ফ্যান ফিকশন পুরন করছে ।
৫) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : এই শূন্যতা পুরোনে অডিও স্টোরি চ্যানেলগুলোর ভুমিকা ?
ইভান : ভুমিকা তো যথেষ্টই হতে পারতো কিন্তু সেটা হলো কই ! এরাই পারতেন ভালো মৌলিক গল্প কে মানুষের সামনে নিয়ে আসতে । কিন্তু সেটা না করে , শর্ট কাট নিলো । শুধুই ব্যোমকেশ , তারানাথ তান্ত্রিক, ফেলুদা , কাকাবাবু ফ্যান ফিকশন । জনপ্রিয় চরিত্র নিয়ে কিছু করলে , অনেক ভিউ হবে ....... এই সব আর কি ।
৬) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : আপনার নিজের ফ্যান ফিকশন লেখা নিয়ে কিছু বলুন ।
ইভান : আমিই প্রথম ফেলুদা কে নিয়ে ফ্যান ফিকশন লিখি । নতুন ফেলুদা পাই না বলেই , একদিন নিজেই একটা প্যারা লিখলাম । তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে একটা সম্পূর্ন গল্প হয়ে গেলো । যেটা লিখলাম সেটা কে যে ফ্যান ফিকশন বলে সেটাও আমি পরে জেনেছি । আমাকে উকিলের সাথে কথা বলে, ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে জানতে হয়েছে ফ্যান ফিকশন এর আইন কানুন কি । তারপর তো এই 'সত্যজিত রায় ক্রিয়েসনস' ফেসবুক পেজে ও ব্লগে সেই গল্প ধারাবাহিক ভাবে বেরোয় । একটি নেট ম্যাগাজিনেও বেরোয় । কোন বাণিজ্যিক লাভ, এর কোনটাতেই ছিল না ।
৭) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : আপনি ফেলুদা ফ্যান ফিকশন লিখেছেন চারটে আর শঙ্কু ফ্যান ফিকশন একটা । এছাড়া মৌলিক গল্প : অলৌকিক, ভুতের , হাসির ও কল্পবিজ্ঞানের গল্পও লিখেছেন । আপনার ফেলুদা ফ্যান ফিকশন নিয়ে একাধিক অডিও স্টোরি হয়েছে ।
ইভান : লেখকের কাজ লেখা । আমি লিখেছি । বিভিন্ন চ্যানেল থেকে যোগাযোগ করে বলা হয় যে তারা অডিও স্টোরি করতে চায় । আমি কোন বাণিজ্যিক লাভ না করে সেই অনুমতি দিই এবং এটাও বলা আছে সেখানে যে এই অডিও স্টোরি বানাতে গিয়ে যদি কোন প্রকারের আইন লঙ্ঘন হয় তাহলে চ্যানেল সেই কাজ যেন না করে । আমার পক্ষে তো জানা সম্ভব নয় কোন চ্যানেল পাবলিক ভিউইং করছে আর কে প্রাইভেট ভিউইং করছে । তবে এসব আগের কথা । ফ্যান ফিকশন আমি আর লিখবো না । গোয়েন্দা মানিক নামে একটি চরিত্র তৈরী করে একাধিক গল্প লিখেছি । ভবিষ্যতে গোয়েন্দা গল্প আরো লিখলে, এই গোয়েন্দা মানিক কে নিয়েই লিখবো ।
৮) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : ফ্যান ফিকশনে কপি রাইট এর সময় সীমা খুব গুরুত্বপুর্ন বোধহয় ?
ইভান : ওটাই আসল । লেখক মারা যাবার পরের বছর থেকে ৬০ বছর অব্দি কপিরাইট সময় সীমা থাকে আমাদের দেশে, যদি না অন্য রকম কোন চুক্তি থাকে ।
৯) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : যারা ৬০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোন গল্প নিয়ে কাজ করবেন তাদের কোন বাধা নেই ?
ইভান : বাধা থাকার কথা নয় । কিন্তু এইটাও বলি, বাধা নেই মানেই যা খুশি লেখা নয় । ফ্যান ফিকশন লেখার কত গুলো নিয়ম আছে । মূল লেখকের রচনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে , লিখতে হয় । চরিত্রকে দিয়ে যা খুশী বলিয়ে বা করিয়ে নেওয়া যায় না । কিন্তু সেইটাই অনেকে করছেন । ফেলুদার সিগারেট ছাড়িয়ে তাকে ভাজা মৌরি না কি যেন খাওয়াচ্ছেন । অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখক ও চ্যানেল মালিক দুজনেই ।
১০) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : কোন পরিবর্তনই কি উচিত নয় ?
ইভান : কিছুটা আবশ্যিক । যেমন ফেলুদা ফ্যান ফিকশনে, ফেলুদা যদি আজকের সময়ে তদন্ত করেন এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার না করেন, নেট সার্ফ না করেন সেটা অবাস্তব । ফেলুদা যদি নন ফিল্টার চারমিনার খান সেটাও অবাস্তব কারন আমরা জানি এখন ওই ব্র্যান্ড উপলব্ধ নয় । বাস্তব থেকে সরা চলবে না । সত্যজিৎ রায় যখন ফেলুদা লিখেছিলেন তখন যেটা বাস্তব ছিল সেটাই লিখেছিলেন । লেখক জীবিত থাকলে এখন যে ভাবে লিখতেন সেইটা অনুমান করেই একজন ভাল ফ্যান ফিকশন লেখক লেখেন । আপনি কোন পিরিয়ডে আপনার গল্প রাখছেন সেইটা ইম্পর্ট্যান্ট ।
১১) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : একজন ফ্যান ফিকশন লেখক ও একজন মৌলিক গল্প লেখকের মধ্যে কি পার্থক্য ?
ইভান : ভালো হলে একটাই পার্থক্য । ফ্যান ফিকশন লেখক চাইলেই মৌলিক লেখা লিখতে পারেন কিন্তু একজন মৌলিক গল্প লেখক চাইলেই ফ্যান ফিকশন লিখতে পারবেন না । ইন ফ্যাক্ট ফ্যান ফিকশন লেখক তো মৌলিক লেখাই লিখছেন, গল্পের প্লট তো তার নিজের । শুধু মুল কিছু চরিত্রের নাম ও ভাব ভঙ্গি বাদ দিয়ে । এবং তিনি একজন বিখ্যাত লেখকের গল্প বলার স্টাইলেই গল্পটা বলছেন । তার জন্য অনেকদিন ধরে তাকে সেই স্টাইলটা স্টাডি করতে হয়েছে, এবং তার নিজের মুন্সিয়ানা তো থাকতে হবেই ।
১২) সত্যজিৎ রায় ক্রিয়েসনস্ : শেষ প্রশ্ন । আমাদের দেশে অডিও স্টোরির ভবিষ্যত কেমন বলে মনে হয় ?
ইভান : খুবই উজ্জ্বল । সাধারণ মানুষের রিডিং হ্যাবিট কিন্তু বেড়ে গেছে । সে হোয়াটসঅ্যাপ , ফেসবুক , পিডিএফ এই সবে কিন্তু আগের থেকে অনেক বেশী কনটেন্ট পড়ছে । আর ছাপা বই এর দাম বেড়ে গেছে অনেক । সেই তুলনায় ই-বুক পড়া অনেক খরচ কম । আর একটা বিরাট বড় সংখ্যার মানুষের গল্প জানার ইচ্ছে আছে কিন্তু পড়ার সময় নেই । তারা কাজ করতে করতে অডিও স্টোরি রূপান্তর শুনছেন । বিদেশে তো অডিও বুকের বিক্রীই বেশী । আগে অনেক ভালো লেখক, বড় বই প্রকাশকদের কাছে পাত্তাই পেতো না । এখন মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া অনেক সহজ । একটা ব্যাপার বড় বড় প্রকাশক, চিত্র পরিচালক, ইউটিউব চ্যানেল মালিক, অন্য যে কোন মাধ্যম ও সাধারন মানুষ কে বুঝে নিতে হবে । সব চেয়ে শক্তিশালী হলো কন্সেপ্ট যার, আইডিয়া যার, যিনি লেখক । তার সৃষ্টি নিয়েই সিনেমা, নাটক, অডিও স্টোরি এই সব কান্ড হচ্ছে । তাঁকে সেই গুরুত্বটা দিতে হবে, টাকায় ও সম্মানে । লেখকদেরও নিজের গুরুত্ব বুঝতে হবে ।
সমাপ্ত
© Copyright : All Rights Reserved